বহুল আলোচিত

হারিয়ে যাওয়া যত প্রাণী

এই পৃথিবী এক রহস্যময়। রহস্য তার চারদিকে থাকা প্রাণীজগৎ নিয়েও। এ পৃথিবীতে থাকা নানা প্রজাতির প্রাণীর অধিকাংশই আমাদের অচেনা। অনেক প্রজাতিই ...

Friday, May 12, 2017

ঢাকার পাশেই এখন ছোট কক্সবাজার

আমাদের কম বেশি সবারই মনে একটু হলেও আক্ষেপ আছে- ঢাকায় কেন কোনো পাহাড় নেই? যদি থাকতো, তাহলে কোনো এক মন খারাপ করা বিকেলে পাহাড়ের কাছে সব দুঃখগুলো জমা দিয়ে আসতাম। কেন কোনো সমুদ্র নেই? যদি থাকতো তাহলে রাতের নিঃশব্দতায় সমুদ্রের কাছে চুপি চুপি গিয়ে জেনে আসতাম- কেন রাত হলেই মন কাঁদে?See More...
প্রতিদিনের কাজের রুটিন, এই মক্কেলের ফরমায়েশ ঐ মক্কেলের ফরমায়েশ পালন করতে করতে মনে জং ধরে গিয়েছিলো। এই জং কোথাও ঘুরতে না গেলে ঠিক হবে না। তাই কলিগেরা মিলে ঠিক করলাম  ঘুরতে যাবো। একেকজন একেক জায়গায় যাওয়ার পরামর্শ দিলো। কেউ বলল সুন্দরবন, কেউ বলল পাহাড় দেখবে, আবার কেউ বলল “চলেন, কক্সবাজার যাই।” কিন্তু সময় যে একদমই অল্প। এই অল্প সময়ের মধ্যে কি এগুলো দেখে মন ভরবে?
ঠিক করলাম ছোট কক্সবাজার যাবো। ছোট কক্সবাজার? এটা আবার কি? বসের প্রশ্ন! ঢাকার অদূরেই বেশ কিছুদিন হলো একটা ছোট কক্সবাজার হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে মৈনট ঘাট। সেখানে গেলে আপনি মুগ্ধ হবেন, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন অপরূপ জলরাশির দিকে। শুনেই প্রাণটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। আমরা পাঁচজন কলিগ পরদিন সকাল বেলায় রওনা হলাম মৈনট ঘাট।
ঢাকা থেকে মৈনট ঘাটে আসার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়টি হচ্ছে গুলিস্তানের গোলাপ শাহের মাজারের সামনে থেকে সরাসরি মৈনট ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা যমুনা পরিবহনে চেপে বসা। ৯০ টাকা ভাড়া আর দেড় থেকে আড়াই ঘন্টার বিনিময়ে আপনি পৌঁছে যাবেন মৈনট ঘাট। ফেরার সময় একই বাসে আবার ঢাকা চলে আসবেন। মৈনট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে শেষ বাসটি ছেড়ে যায় সন্ধ্যা ৬টায়। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকেও আসার একটা পদ্ধতি আছে। মোহাম্মদপুর বেরিবাঁধের সিএনজি স্টেশন থেকে আটিবাজার, আটিবাজার থেকে সিএনজি অথবা একপ্রকার ছাদহীন টেম্পুতে কোনাখোলা। কোনাখোলা থেকে দোহার-নবাবগঞ্জগামী যেকোনো একটা বাসে উঠে পড়তে হবে। যারা প্রাইভেট কার অথবা বাইক নিয়ে আসতে চাচ্ছেন, তারা এই বাসের রুটটাকে ব্যবহার করতে পারেন। আসতে বেশ সুবিধা হবে।
পথিমধ্যে চাইলে লক্ষীপ্রসাধে নেমে ‘পোদ্দারবাড়ি’ নামে একটি পুরনো বাড়িও দেখে নিতে পারেন। আর জজবাড়ি, উকিলবাড়ি, কোকিলপ্যারি দালান, খেলারাম দাতার বাড়ি- যাকে স্থানীয়ভাবে ‘আন্ধার কোঠা’ বলা হয়, এসব দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে চাইলে মাঝিরকান্দার আগে ‘কলাকোপা’ নামক স্থানেই নামতে হবে। ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে আসা একটি রাস্তা সোজা গিয়ে ইতি টেনেছে দোহারের মৈনট ঘাটে। এখানে এসে সড়কটির দু’পাশের চর দেখে অনেকেরই ভুল মনে হতে পারে। এটি কি নদীর চর, নাকি সমুদ্রের কোনো বেলাভূমি!
মৈনট ঘাট ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার একটি জায়গা। এপারে দোহার, আর ওপারে ফরিদপুর। মৈনট ঘাট থেকে ফরিদপুরের গোপালপুরের স্পিডবোটে পারাপার হন মানুষ। বিশাল জলরাশি, পদ্মায় হেলেদুলে ভেসে বেড়ানো জেলেদের মাছ ধরা নৌকা দেখা আর পদ্মার তীরে হেঁটে বেড়ানো, সব মিলিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার মনে হবে আপনি এখন ঢাকার দোহারে নয়, আসলেই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আছেন। মূলত এই কারণেই অনেকে মৈনট ঘাটকে বলে থাকেন ‘ছোট কক্সবাজার’
আমরা যেহেতু পাঁচজন গিয়েছিলাম, তাই আমাদের আনন্দটা একটু বেশিই ছিল। এক মুহূর্তের জন্য আমরা ভেবে নিয়েছিলাম আমরা সমুদ্রের পাড়েই বসে আছি। পদ্মার পাড় সমুদ্রের থেকে কম নয়। যেহেতু আমার বাবার বাড়ি পদ্মার ওপারে, তাই ভালো লাগা যেন দ্বিগুণ ছিল।
মৈনট ঘাট পরিদর্শনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। তখন রাস্তার দু’পাশের নিম্নভূমি, যেখানে বর্ষায় বিস্তীর্ণ ভূমি জুড়ে বাদামের চাষ করা হয়, সবই তখন পদ্মার পানিতে তলিয়ে যায়। তবে শুকনো সময়েও এর সৌন্দর্যের কমতি নেই। তখন আবার দেখা যাবে পদ্মা নদীর শান্ত রূপ। পদ্মার শান্ত রূপ দেখে আপনারও মনে ভরে যাবে এক শান্ত-শীতল অনুভূতিতে। তবে আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন অনেক মানুষ ছিলো।
কিছুক্ষণ পাড়ে বসে থেকে দেখছিলাম পদ্মার পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি। অনেকে আবার ফুটবল নিয়ে এসে খেলছিলো। ঢাকার আশেপাশে হওয়ার কারণে প্রচুর মানুষ এখানে আসছে, ঘুরছে, মজা করছে। তাদের দেখে আমরাও আর বসে থাকতে পারলাম না। নেমে পড়লাম পানিতে। আপনারা যারা এখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তারা অবশ্যই এক সেট অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে যেতে ভুলবেন না। আমরা যেহেতু নিয়ে যেতে পারিনি, তাই রোদের তাপেই নিজেদের গায়ের কাপড় শুকিয়ে নিয়েছিলাম। ওহ! আরেকটি কথা, গোসল করতে নেমে যারা সাঁতার জানেন, তারাও ভুলেও গভীর পানিতে যাবেন না। কারণ পদ্মা কখনো কখনো সমুদ্রের থেকেও ভয়াবহ। পদ্মার রূপ পরিবর্তন করতে এক সেকেন্ডও লাগে না। এই বালি, আবার এই পানি!
মজার ব্যাপার হচ্ছে খুব ভোরে মৈনট ঘাটেই বসে আপনি দেখতে পাবেন সারা রাত পদ্মা নদীতে জেলেদের শিকার করা মাছের বাজার। পদ্মা নদীর সেই নামকরা ইলিশসহ অনেক প্রজাতির মাছই আপনি কিনতে পারবেন এখান থেকে, তাও একদম টাটকা! মৈনট ঘাটে আপনি আরো দেখতে পাবেন পদ্মা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা পদ্মাবিধৌত অতিসাধারণ এক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন, যারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও পদ্মাকে বুকে আগলে ধরে আছে বছরের পর বছর। সর্বনাশা পদ্মার সাথে যুদ্ধ করে এরা এখনো টিকে আছে পরম মমতা আর ভালোবাসা নিয়েই।
আমরা অনেকটা সময় পানিতেই মেতে ছিলাম। এক পর্যায় ক্ষুধার কাছে হার মেনে খাওয়ার খোঁজে বের হয়ে পড়ি। তাজা ইলিশ শুনলেই জিভে জল চলে আসে আমার। যেহেতু এর আগেও বহুবার পদ্মা নদীর পাশে বসে ইলিশ খাওয়া হয়েছে, তাই এবারও এর ব্যতিক্রম হলো না।
মৈনট ঘাটে মাত্র দুটি ভাতের হোটেল আছে। একটি আতাহার চৌধুরীর হোটেল, অপরটি জুলহাস ভূঁইয়ার। এছাড়া কার্তিকপুর বাজারে শিকদার ফাস্টফুড নামে একটি খাবারের দোকান আছে। ঢাকা হোটেলসহ আরো কিছু ভাতের হোটেলও আছে। খাবার একদম ফার্স্ট ক্লাস বলতেই হচ্ছে। ভাত একদম ঝরঝরে। ওরা মাছের ভর্তাও বানায়। সাথে চিংড়ি, বোয়াল, রুই মাছের তরকারী কিংবা মুরগী, গরু, হাঁসের গোশত চাইলেই পাওয়া যাবে। তবে এসব কিছুর পর কার্তিকপুরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি খেতে ভুলবেন না যেন! এখানকার মিষ্টি অনেকে বিদেশেও পাঠায়। নিরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মুসলিম সুইটস, রণজিৎ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারসহ আরো কিছু মিষ্টির দোকান সেখানে আছে। খাওয়া শেষ করতে করতে বিকেল চলে এলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার জন্য আমরা একটা খালি নৌকা পেয়ে গেলাম। বাইরে তখন তপ্ত গরম। কিন্তু নৌকার ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাস আপনার ঘুম চলে আসবেই!
সাথে যদি কোন গায়ক বন্ধু-বান্ধব নিয়ে যান, তাহলে গান আর আড্ডা সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখবে। আর আপনি যদি ফটোগ্রাফার হন, তাহলে পেয়ে যাবেন ফ্রেমে টানিয়ে রাখার মতো বেশ কিছু সুন্দর ছবি।
নানান কারণেই মৈনট ঘাট এখন ঢাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এর প্রধান কারণ ঘাটের আশপাশে, বিশেষ করে পূর্ব পাশে বিশাল চর আর সামনে বিস্তীর্ণ পদ্মা। এখান থেকে পদ্মা নদীতে নৌকায় ঘুরেও বেড়ানো যায় পাড় ধরে। তাছাড়া এ মৌসুমে প্রচুর রংবেরংয়ের পালের নৌকাও দেখা যায় মৈনট ঘাটে।
আমরা ঠিক করলাম কিছুক্ষণ নৌকা দিয়ে ঘুরবো। বিকেলবেলা, তাই নদী তখন অনেকটাই শান্ত। একটা নৌকা ঠিক করে নিলাম। মৈনট ঘাট থেকে পদ্মায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য আরও আছে স্পিডবোট। আটজনের চড়ার উপযোগী একটি বোটের ভাড়া ত্রিশ মিনিটের জন্য দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এছাড়া ছোট-বড় নানান আকারের ইঞ্জিন নৌকাও আছে। আড়াইশ থেকে আটশ টাকা ঘণ্টায় এসব ইঞ্জিন নৌকায় চার থেকে ২০/২৫ জন একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো যায়। তবে পদ্মার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে দুই/তিন ঘণ্টার জন্য ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে মৈনট ঘাটের কোলাহল ছেড়ে একটু দূর থেকে ঘুরে আসাই ভালো।
সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সময় হয়ে গেলো ঘরে ফেরার। পাখিরা যেমন অন্ধকার হয়ে গেলেই নীড়ে ফিরে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের একটা সময় নীড়ে ফিরতে হয়। মৈনট ঘাট ও পদ্মার সৌন্দর্য উপভোগের জন্য আসলে দিনের দ্বিতীয়ভাগই ভালো। সেখানে সূর্যাস্ত না দেখে ফেরা উচিৎ হবে না।
যেকোনো জায়গায় ঘুরতে গেলে আমাদের কিছু সাবধানতা মেনে চলতে হয়। আর এটা যেহেতু পানিপথের ভ্রমণ, তাই আরো বেশি সাবধান থাকা উচিত। যেমন নৌকায় উঠে বেশি উত্তেজিত হয়ে এমন কিছু না করা যেটাতে নিজের অথবা অন্যের ক্ষতি হয়। সিগারেট অথবা খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল অথবা যেকোনো প্রকার ময়লা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। পাখি মারা থেকে বিরত থাকুন। দোকানদার, নৌকাচালক সহ সবার সাথে মার্জিত ব্যবহার করুন। তাদেরকে ছোট করে দেখবেন না।
যদি আপনি খুব ভালো সাঁতারু হন আর কেউ পানিতে কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়, তাহলে তাকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করুন। খেয়াল রাখুন নিজের কোনো আচরণের দ্বারা কোনো মেয়ে বিরক্ত হলো কিনা। কেউ মেয়েদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করলে মেয়েটিকে সাহায্য করুন অথবা যেকোনো প্রকার সাহায্যের জন্য মৈনট ঘাটের একটু পাশেই অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়িতে যোগাযোগ করুন।
ধুলোর শহর এবং যান্ত্রিক নগরী ঢাকার আশেপাশে ঘুরার জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণেও ছুটির দিনগুলো অনেক সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। কিন্তু চাইলেই ছুটির দিনে অথবা কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ঘুরে আসতে পারেন ছোট কক্সবাজার খ্যাত মৈনট ঘাট থেকে।
হ্যাপি ভ্রমণিং!


No comments:

Post a Comment